
ভূমিকা
পৃথিবী — এই রহস্যময়, জীবন্ত গ্রহ, যেখানে মানবজাতির বসবাস। আমরা প্রতিদিন সূর্যোদয় দেখি, প্রকৃতির রূপ উপভোগ করি, কিন্তু কজন জানি, এই গ্রহটির জন্ম কীভাবে হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মানুষ বহু যুগ ধরে বিভিন্ন চিন্তাধারা ও ব্যাখ্যা তুলে ধরেছে। কিছু ব্যাখ্যা এসেছে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে, আবার কিছু এসেছে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে। এই আর্টিকেলে আমরা জানবো কিভাবে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে—বিজ্ঞান ও ধর্মীয় উভয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। পাশাপাশি আলোচনায় থাকবে আধুনিক আবিষ্কার, মিথ ও কল্পকাহিনীর প্রসঙ্গ।
বিজ্ঞান কী বলে পৃথিবীর সৃষ্টির ব্যাপারে?
বিগ ব্যাং থিয়োরি: সব কিছুর শুরু
বর্তমান বিজ্ঞানে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হচ্ছে বিগ ব্যাং থিয়োরি। এই তত্ত্ব অনুসারে, আজ থেকে প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে, একটি অতিপ্রচণ্ড বিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের জন্ম হয়। এই বিস্ফোরণের পূর্বে কোনো সময়, স্থান বা পদার্থ ছিল না। সেই এক বিন্দু থেকে সময়, স্থান ও শক্তি প্রসারিত হতে থাকে, এবং গঠিত হয় মহাবিশ্ব।
এই ঘটনা থেকেই শুরু হয় সমস্ত গ্যালাক্সি, নক্ষত্র ও গ্রহের উৎপত্তি। এটি ছিল এমন একটি মুহূর্ত যা সময়ের শুরু এবং মহাবিশ্বের সূচনা বলে ধরা হয়।
সৌরজগতের সৃষ্টি ও পৃথিবীর গঠন
বিগ ব্যাং-এর প্রায় ৯ বিলিয়ন বছর পরে, অর্থাৎ প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে, একটি গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘ (nebula) ধসে পড়ে এবং ঘূর্ণন শুরু করে। এই মেঘের কেন্দ্রবিন্দুতে সূর্যের সৃষ্টি হয়, এবং এর আশেপাশে থাকা পদার্থগুলো একত্রিত হয়ে তৈরি করে বিভিন্ন গ্রহ, চাঁদ ও ধূমকেতু—এর মধ্যে একটি ছিল আমাদের পৃথিবী।
প্রাথমিক পৃথিবী: আগুনের বলয়
সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবী ছিল সম্পূর্ণভাবে উত্তপ্ত, গলিত ধাতু ও আগ্নেয় শিলায় পূর্ণ। বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তুর (যেমন উল্কা) আঘাতে এটি আরও উত্তপ্ত হয় এবং এর অভ্যন্তরে লোহা ও নিকেলের মতো ভারী মৌলগুলি নিম্নগামী হয়ে কেন্দ্র তৈরি করে। উপরের দিকে হালকা পদার্থগুলি উঠে গিয়ে ভূত্বক গঠন করে।
বায়ুমণ্ডল ও জলবায়ুর সূচনা
পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ উত্তাপে উৎপন্ন গ্যাস থেকে গঠিত হয় প্রাথমিক বায়ুমণ্ডল। এতে প্রধানত ছিল কার্বন ডাইঅক্সাইড, জলীয় বাষ্প ও নাইট্রোজেন। দীর্ঘ সময় ধরে এই জলীয় বাষ্প সংক্ষেপিত হয়ে বৃষ্টির মাধ্যমে মহাসাগর গঠন করে। এভাবে পৃথিবীতে এক সময় পানি, স্থল এবং বায়ুর সমন্বয়ে প্রাণের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়।
প্রাণের উৎপত্তি (Origin of Life)
প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে, জীবনের সূচনা ঘটে পৃথিবীতে। বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্রের গভীরে থাকা হাইড্রোথার্মাল ভেন্টস বা বজ্রসহ ঝড়ঝাপটায় রসায়নিক বিক্রিয়া চলতে থাকে—যেখান থেকে গঠিত হয় অ্যামিনো অ্যাসিড ও প্রোটিনের মতো মৌলিক উপাদান। এইসব এককোষী জীব (unicellular organisms) থেকে ধীরে ধীরে বহুকোষী প্রাণী, উদ্ভিদ এবং মানুষ পর্যন্ত বিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে।
ধর্মীয় ব্যাখ্যায় পৃথিবীর সৃষ্টি
ইসলাম ধর্মে সৃষ্টির ধারণা
ইসলাম ধর্মে বলা হয় যে, আল্লাহ পৃথিবী ও মহাবিশ্বকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। এই ছয় দিনের মধ্যে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন আকাশ, জমিন, পাহাড়, নদী, গাছপালা, প্রাণী এবং অবশেষে মানুষ।
“তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন…”
— (সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত ৫৪)
এছাড়া কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন মানুষকে মাটি থেকে, এবং সমস্ত কিছু তার নির্দেশ অনুযায়ী চলছে।
খ্রিস্টান ধর্মে সৃষ্টি
খ্রিস্টান ধর্ম মতে, ঈশ্বর প্রথমে আলো সৃষ্টি করেন, তারপর আকাশ, পানি, জমিন, উদ্ভিদ, চাঁদ-সূর্য, প্রাণী এবং সবশেষে মানুষ। এই সমস্ত কাজ তিনি ছয় দিনে সম্পন্ন করেন এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেন। এই ব্যাখ্যা বাইবেলের “Genesis” অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।
হিন্দুধর্মে সৃষ্টি কাহিনী
হিন্দুধর্মে রয়েছে একাধিক সৃষ্টিকাহিনী। এর মধ্যে একটি হলো, ব্রহ্মা এই সৃষ্টির জনক, যিনি স্বয়ং বিষ্ণুর নাভিকমলে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনিই সৃষ্টি করেন পৃথিবী ও জীবজগৎ।
নাসদীয়া সূক্ত (Rig Veda) বলছে:
“সৃষ্টির পূর্বে কিছুই ছিল না, আলো ছিল না, অন্ধকার ছিল না, আকাশ ছিল না, বাতাস ছিল না…” এখানে সৃষ্টিকে একটি ধ্যানমগ্ন রহস্যময় শক্তি থেকে উদ্ভূত বলা হয়েছে, যা সময়, স্থান ও অস্তিত্বকে পেরিয়ে গেছে।
পৃথিবীর গঠন: ধাপে ধাপে
১. ভূত্বক (Crust)
প্রথমে পৃথিবীর উপরিভাগে গঠিত হয় কঠিন শিলা, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে পর্বত, মালভূমি ও সমতলভূমি তৈরি করে।
২. ম্যান্টল ও কোর
পৃথিবীর অভ্যন্তরে রয়েছে ম্যান্টল (Mantle) ও কোর (Core)। কোর দুটি ভাগে বিভক্ত: বাইরের তরল কোর ও ভিতরের কঠিন কোর। এই অংশগুলি পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৩. প্রাণের বিকাশ ও বিবর্তন
প্রথম জীব উৎপন্ন হওয়ার পরে শুরু হয় দীর্ঘ বিবর্তন প্রক্রিয়া। এককোষী প্রাণী থেকে মাছ, উভচর, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং অবশেষে মানুষ সৃষ্টি হয়—এটাই ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব।
আধুনিক আবিষ্কার: বিজ্ঞান কোথায় দাঁড়িয়েছে?
বর্তমানে পৃথিবীর সৃষ্টির ইতিহাস জানার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে:
- রেডিওআইসোটোপ ডেটিং (Radioisotope Dating): এর মাধ্যমে পাথরের বয়স নির্ণয় করা যায়
- হাবল টেলিস্কোপ ও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ: মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে সহায়তা করছে
- CERN ও কণিকা ত্বরণ যন্ত্র: মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রাথমিক ক্ষুদ্র কণাগুলোর আচরণ বিশ্লেষণ করা হয়
বিজ্ঞান বনাম ধর্ম: দ্বন্দ্ব না সম্পূরক?
অনেক সময় মনে হতে পারে বিজ্ঞান ও ধর্ম একে অপরের বিপরীত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারা পৃথিবীর সৃষ্টি নিয়ে আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা প্রদান করে।
- বিজ্ঞান বলে কীভাবে সৃষ্টি হলো
- ধর্ম বলে কেন সৃষ্টি হলো
এই দুটি ব্যাখ্যা যদি সঠিকভাবে বোঝা যায়, তাহলে একে অপরকে পরিপূরক হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
উপসংহার পৃথিবী কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে—এই প্রশ্নের একক কোনো উত্তর নেই। বিভিন্ন ধর্ম একে দেখে এক ঈশ্বরের পরিকল্পনা হিসেবে, বিজ্ঞান একে বিশাল এক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ফল হিসেবে বিবেচনা করে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই এটি এক অপূর্ব ও রহস্যময় ঘটনা।